খাদ্যের উপাদান, কাজ ও উৎস Food ingredients, functions and sources
খাদ্যের উপাদান, কাজ ও উৎসঃ
আমরা শরীর সুস্থ রাখার জন্য যে খাদ্যসমূহ গ্রহণ করে থাকি তাতে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান থাকে। অধিকাংশ খাদ্যেই এক বা একাধিক খাদ্য উপাদান থাকে। খাধ্যে যে উপাদান বেশি পরিমাণে থাকে, তাকে কে উপাদানযুক্ত খাদ্য বলা হয়।
খাদ্যের উপাদানগুলোকে সাধারণত হয় ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
শর্করা (Carbohydrate)
আমিষ (Protein)
স্নেহ বা চর্বি (Fat)
খনিজ লবণ (Minerals)
খাদ্যপ্রাণ (Vitamine)
পানি (Water)
শর্করারঃ শর্করা মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার জৈব যৌগ, যা সকল প্রকার উদ্ভিদে পাওয়া যায়। শর্করার স্বাদ মিষ্টি বা মিষ্টিহীন এবং রং সাদা। উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা উৎপন্ন হয়, যা দাহ্য হয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড পানি ও শক্তি (ক্যালরি) উৎপন্ন করে। শর্করা প্রধানত তিন প্রকার, যথা- মনোস্যাকারাইড, ডাইস্যাকারাইড ও পলিস্যাকারাইড। প্রায় সব ধরনের শর্করাই পানিতে দ্রবণীয়। সেলুলোজ (আঁশ ) শর্করার একটি অপাচ্য ধরন যা ধান, গম, যব ও শাকসবজির উপরের খোসা বা বাকলে পাওয়া যায়। এই সেলুলোজ মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
শর্করার কাজঃ
শর্করার প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরে তাপ ও শক্তি সরবরাহ করা। ( ১গ্রাম শর্করা হতে ৪ ক্যালরি তাপ শক্তি পাওয়া যায়)
শর্করা স্বল্প আমিষ মূল্যের খাদ্যকে তাপ উৎপাদনের কাজ হতে অব্যহতি দেয়।
কিছু শর্করা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং অন্ত্রের স্বাভাবিক সংকোচন ত্বরাস্বিত করে। যেমন- সেলুলোজ ও পেকটিন ।
কিছু শর্করা রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত শর্করা শরীরে গ্লাইকোজেন হিসেবে জমা থাকে।
দেহকে কিটোসিস নামক রোগ হতে রক্ষা করে।
শর্করার উৎসঃ চাল, আটা, আলুaluআলু, কচু, কচু, কলা, গুড়, চিনি, মধু, ক্যাসাভা, ভুট্রা, আম, খেজুর, বেল, সরিষা, আতা, পেঁপে, চালতা ইত্যাদি।
আমিষঃ আমিষ হচ্ছে নাইট্রোজেন জাতীয় এক প্রকার জটিল জৈব উপাদান। কোষের প্রোটোপ্লাজমের প্রধান উপাদান হচ্ছে প্রোটিন। তাই প্রোটিনকে জীবকোষের প্রাণ বলা হয়। প্রোটিন খাওয়ার পর তা ভেঙ্গে অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত হয়। প্রোটিনে প্রায় ২২ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে । সবচেয়ে উন্নতমানের আমিষ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষ।
আমিষের কাজঃ
প্রধান এবং প্রথম কাজ হলো- দেহ গঠন, বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়পূরণ।
খাদ্যের পরিপাক ও বিপাক কাজের জন্য যে সকল এনজাইম প্রভাবিত করে বা যে সকল এনজাইম সাহায্য করে তা প্রোটিন হতে উৎপন্ন হয়। যেমন-পেপসিন, ট্রিপসিন ইত্যাদি।
আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পদার্থ তৈরি হয়। এরা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
রক্তের হিমোগ্লোবিন নামক আমিষ বাতাস হতে অক্সিজেন গ্রহণ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌছে দেয়।
আমিষও তাপ শক্তি উৎপন্ন করে ( ১ গ্রাম আমিষ হতে প্রায় ৪ ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়।)। পর্যাপ্ত শর্করা ও স্নেহ পদার্থের অভাবে হলে আমিষ ভেঙ্গে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়।
আমিষের অভাবে শরীরের কোষ হতে পানি বের হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে শ্বেত রোগ সৃষ্টি হয়।
আমিষের উৎসঃ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, চীনাবাদাম, মাশরুম ইত্যাদি।
স্নেহ বা চর্বিঃ তেল ও চর্বি জাতীয় খাদ্যকে স্নেহ পদার্থ বলে। ইংরেজিতে একে Fat বা Lipid বলা হয়। এ খাদ্য সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি সরবরাহ করে। স্নেহ জাতীয় খাদ্য ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারল দ্বারা গঠিত ।কোন কোন উদ্ভিদের বীজে ও বাদামে স্নেহ জাতীয় খাদ্য পাওয়া যায়; যেমন- জলপাইয়ের তেল, নারিকেলের তেল, সয়াবিন ও বাদাম তেল ইত্যাদি । শরীরের জন্য প্রাণিজ তেল অপেক্ষা উদ্ভিজ্জ তেল বেশি প্রয়োজন । প্রাণিজ তেল যেমন- ঘি, মাখন চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
স্নেহ জাতীয় পদার্থের কাজঃ
স্নেহ জাতীয় খাদ্য হতে সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয় ( ১ গ্রাম স্নেহ হতে ৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়) ।
স্নেহ জাতীয় খাদ্য তাপ কুপরিবাহী বলে দেহকে গরম রাখে।
এ খাদ্য ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে এর পরিশোষণে সাহায্য করে।
উদ্ভিজ্জ তেলের অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বক ও কোষের সুস্থতা রক্ষা করে।
খাদ্যে স্নেহ জাতীয় পদার্থ ব্যবহারের ফলে খাদ্য সুস্বাদু ও মুখরোচক হয়।
স্নেহ জাতীয় খাদ্যের উৎসঃ সয়াবিন, সরিষা, তিল, সূর্যমুখী বীজ, চীনাবাদাম, নারিকেল,পাম, তুলা বীজ, ডালডা, মার্জারীন, ঘি, মাখন, চর্বি, মছের তেল, ডিম, রাইস ব্রান তেল ইত্যাদি।
খনিজ লবণঃ দেহের অন্যতম উপাদান হচ্ছে খনিজ লবণ। যদিও দেহের প্রায় ৯৬% জৈব পদার্থ ও বাকি ৪% অজৈব পদার্থ বা খনিজ লবণ, তবুও এই অল্প পরিমাণ খনিজ লবণ দেহের কাঠামো গঠনে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। খনিজ লবণের মধ্যে সেগুলোকে Trace element বলে। তবে শরীরে প্রায় ২০টি লবণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । প্রয়োজনীয় খনিজ লবণগুলো হচ্ছে-
ক্যালসিয়াম,
পটাশিয়াম
সোডিয়াম
লৌহ
ম্যাগনেশিয়াম
ম্যাঙ্গানিজ
দস্তা
তামা
লিথিয়াম
ফসফরাস
গন্ধক
ক্লোরিন
বেরিয়াম
আয়োডিন
সিলিকন
ফ্লোরিন ইত্যাদি
এর মধ্যে ১০টি দ্বারা শরীরের ক্ষারীয় এবং ৬টি দ্বারা শরীরের অম্লভাব বজায় থাকে।
ক্ষার জাতীয় লবণঃ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, তামা, লিথিয়াম ও বেরিয়াম।
অম্ল জাতীয় লবণঃ ফসফরাস, গন্ধক, ক্লোরিন, আয়োডিন, সিলিকন ও ফ্লোরিন।
খনিজ লবণের কাজঃ
ক্যালসিয়ামঃ
এর প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের হাড় গঠন ও মজবুতকরণ। শরীরের মোট ক্যালসিয়ামের ৯৯% ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস এর সাথে যু্ক্ত হয়ে এ কাজে ব্যবহার হয়।
ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনোশিয়াম সাথে মাংসপেশি ও স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপনা ও উত্তেজনাকে প্রভাবিত করে।
রক্ত জমাটবাধা ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বদ্ধ করে।
ক্যালসিয়াম খাদ্যের উৎসঃ দুধ, দই, গুঁড়া দুধ, ডিমের কুসুম, বাদাম, শাকসবজি যেমন- সবুজ বরবটি, ব্রকলি ও পালংশাক, ঢেড়স, পনির ছোট মাছ ইত্যাদি।
লৌহঃ
রক্তের লাল অংশ ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। হিমোগ্লোবিন ফুসফুস হতে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
কিছু এনজাইম বা জারক রস গঠনে লৌহের প্রয়োজন।
লৌহ জাতীয় খাদ্যের উৎসঃ কচুশাক, লালশাক, আলু, পুদিনা পাতা, শশা, শালগম, করলা, মুলা, ডাল, পেঁয়াজ, তরমুজ, মটরশুঁটি, খেজুর, যকৃত, মাংস, ডিম,গুড়, তেঁতুল, চিংড়ি, শুটকি মাছ ইত্যাদি।
আয়োডিনঃ
আয়োডিন শরীরে থাইরক্সিন নামক হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।
থাইরক্সিন দৈনিক ও মানসিক বিকাশ বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাবিত করে।
গর্তবতী মায়ের জন্য আয়োডিন খু্বই প্রয়োজন, অন্যথায় প্রতিদন্ধী শিশু জন্ম নিতে পারে।
আয়োডিন জাতীয় খাদ্যের উৎসঃ বিভিন্ন শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ (তাজা ও শুঁটকি), শামুক, ছাগলের দুধ, শেওলা, মাছের তেল ইত্যাদি।
ভিটামিন/খাদ্যপ্রাণঃ শর্করা, আমিষ ও স্নেহ পদার্থ ছাড়াও কিছু কিছু জৈব উপাদান শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়। এগুলোকে খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন বলে। বেরিবেরি ও স্কার্ভি রোগকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন আবিষ্কার হয়েছে । বিশিষ্ট বিঙ্গানীগণ যেমন- অসবার্ন, মেন্ডেল, ম্যাককলাম ও ডেভিস প্রমাণ করেন যে লেবুতে স্কার্ভি প্রতিরোধক ভিটামিন খুবই অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়। দ্রবণীয়তার ভিত্তিতে ভিটামিন দু’প্রকার। যেমন-
চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনঃ ভিটামিন- এ, ডি, ই ও কে।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিনঃ ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন-সি।
ভিটামিনের কাজঃ
ভিটামিন-এ
চোখ সুস্থ রাখে ও স্বল্প আলোতে দেখার ক্ষমতাকে রক্ষা করে।
অস্থিকোষ ও দাঁতের গঠনকে প্রভাবিত করে।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ত্বকের কোষকে ভাল ও মসৃণ রাখে।
উৎসঃ সয়াবিন, চাল, ভুট্রা, লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, মাছের তেল, কলিজা, মাখন, ডিমের কুসুম, পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা কাঁঠাল, মিষ্টি আলু ইত্যাদি।
ভিটামিন-ডি এর কাজঃ
শরীরের অন্ত্র ও বৃক্ক হতে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণে সাহায্য করে।
শরীরের হাড় ও দাঁত সুগঠিত ও মজবুত করে।
শিশুদের রিকেট ও বয়স্কদের অস্টিওম্যালেসিয়া রোগ প্রতিরোধ করে।
উৎসঃ ডিমের কুসুম, দুধ, মাখন, ও যকৃত ও তৈলাক্ত মাছ। উদ্ভিজ্জ উৎসে সাধারণত ভিটামিন-ডি নেই।
ভিটামিন-ই এর কাজঃ
কোষের ঝিল্লি গঠন করে।
ক্যারোটিন বিপাকে সহায়তা করে।
গর্ভপাত প্রবণতা কমিয়ে দেয়।
উৎসঃ উদ্ভিজ্জ তেল (বাদাম, ভুট্রা, সূর্যমুখী, সয়াবিন, পাম, নারিকেল ইত্যাদি) এ ভিটামিনের উৎকৃষ্ট উৎস। দুধ, মাখন, ডিমেও এই ভিটামিন পাওয়া যায়।
ভিটামিন-কে এর কাজঃ
রক্ত জমাটকরণ কাজে সহায়তা করে।
রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে।
উৎসঃ লেটুস, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, মটরশুঁটি, কলিকা, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদ।
ভিটামিন-সিঃ
এটি কোলাজেন নামক আমিষ তৈরি করে হাড়, তরুণাস্থি ও ত্বকের রক্ষণাবেক্ষণ করে।
রক্তের বিশুদ্ধতা ও রক্ত গঠনে সহায়তা করে।
ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি শুকাতে সাহায্য করে।
এটি জারণ প্রতিরোধক বা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
মাংসপেশির শক্তিবৃদ্ধিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে।
দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখে।
উৎসঃ সব রকম টাটকা ফল ও সবজি, আমলকি, পেয়ারা, কুল, কামরাঙ্গা, আমড়া, আনারস, জাম্বুরা, লেবু, কাঁচামরিচ ইত্যাদি শুকনা ফল ও বিচি এবং টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে ভিটামিন-সি থাকে না।
পানিঃ আম, কাঁঠাল, ডাব,তরমুজ, পেঁপে, আনারস, জাম্বুরা, আখ বিভিন্নি প্রকার ফল ও সবজিতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে। মানবদেহের প্রায় ৬৩% পানি । শরীরে পানির ঘাটতি হলে নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়।
আমরা শরীর সুস্থ রাখার জন্য যে খাদ্যসমূহ গ্রহণ করে থাকি তাতে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান থাকে। অধিকাংশ খাদ্যেই এক বা একাধিক খাদ্য উপাদান থাকে। খাধ্যে যে উপাদান বেশি পরিমাণে থাকে, তাকে কে উপাদানযুক্ত খাদ্য বলা হয়।
খাদ্যের উপাদানগুলোকে সাধারণত হয় ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
শর্করা (Carbohydrate)
আমিষ (Protein)
স্নেহ বা চর্বি (Fat)
খনিজ লবণ (Minerals)
খাদ্যপ্রাণ (Vitamine)
পানি (Water)
শর্করারঃ শর্করা মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার জৈব যৌগ, যা সকল প্রকার উদ্ভিদে পাওয়া যায়। শর্করার স্বাদ মিষ্টি বা মিষ্টিহীন এবং রং সাদা। উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা উৎপন্ন হয়, যা দাহ্য হয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড পানি ও শক্তি (ক্যালরি) উৎপন্ন করে। শর্করা প্রধানত তিন প্রকার, যথা- মনোস্যাকারাইড, ডাইস্যাকারাইড ও পলিস্যাকারাইড। প্রায় সব ধরনের শর্করাই পানিতে দ্রবণীয়। সেলুলোজ (আঁশ ) শর্করার একটি অপাচ্য ধরন যা ধান, গম, যব ও শাকসবজির উপরের খোসা বা বাকলে পাওয়া যায়। এই সেলুলোজ মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
শর্করার কাজঃ
শর্করার প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরে তাপ ও শক্তি সরবরাহ করা। ( ১গ্রাম শর্করা হতে ৪ ক্যালরি তাপ শক্তি পাওয়া যায়)
শর্করা স্বল্প আমিষ মূল্যের খাদ্যকে তাপ উৎপাদনের কাজ হতে অব্যহতি দেয়।
কিছু শর্করা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং অন্ত্রের স্বাভাবিক সংকোচন ত্বরাস্বিত করে। যেমন- সেলুলোজ ও পেকটিন ।
কিছু শর্করা রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত শর্করা শরীরে গ্লাইকোজেন হিসেবে জমা থাকে।
দেহকে কিটোসিস নামক রোগ হতে রক্ষা করে।
শর্করার উৎসঃ চাল, আটা, আলুaluআলু, কচু, কচু, কলা, গুড়, চিনি, মধু, ক্যাসাভা, ভুট্রা, আম, খেজুর, বেল, সরিষাসরিষা, আতা, পেঁপে, চালতা ইত্যাদি।
আমিষঃ আমিষ হচ্ছে নাইট্রোজেন জাতীয় এক প্রকার জটিল জৈব উপাদান। কোষের প্রোটোপ্লাজমের প্রধান উপাদান হচ্ছে প্রোটিন। তাই প্রোটিনকে জীবকোষের প্রাণ বলা হয়। প্রোটিন খাওয়ার পর তা ভেঙ্গে অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত হয়। প্রোটিনে প্রায় ২২ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে । সবচেয়ে উন্নতমানের আমিষ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষ।
আমিষের কাজঃ
প্রধান এবং প্রথম কাজ হলো- দেহ গঠন, বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়পূরণ।
খাদ্যের পরিপাক ও বিপাক কাজের জন্য যে সকল এনজাইম প্রভাবিত করে বা যে সকল এনজাইম সাহায্য করে তা প্রোটিন হতে উৎপন্ন হয়। যেমন-পেপসিন, ট্রিপসিন ইত্যাদি।
আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পদার্থ তৈরি হয়। এরা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
রক্তের হিমোগ্লোবিন নামক আমিষ বাতাস হতে অক্সিজেন গ্রহণ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌছে দেয়।
আমিষও তাপ শক্তি উৎপন্ন করে ( ১ গ্রাম আমিষ হতে প্রায় ৪ ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়।)। পর্যাপ্ত শর্করা ও স্নেহ পদার্থের অভাবে হলে আমিষ ভেঙ্গে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়।
আমিষের অভাবে শরীরের কোষ হতে পানি বের হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে শ্বেত রোগ সৃষ্টি হয়।
আমিষের উৎসঃ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, চীনাবাদাম, মাশরুম ইত্যাদি।
স্নেহ বা চর্বিঃ তেল ও চর্বি জাতীয় খাদ্যকে স্নেহ পদার্থ বলে। ইংরেজিতে একে Fat বা Lipid বলা হয়। এ খাদ্য সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি সরবরাহ করে। স্নেহ জাতীয় খাদ্য ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারল দ্বারা গঠিত ।কোন কোন উদ্ভিদের বীজে ও বাদামে স্নেহ জাতীয় খাদ্য পাওয়া যায়; যেমন- জলপাইয়ের তেল, নারিকেলের তেল, সয়াবিন ও বাদাম তেল ইত্যাদি । শরীরের জন্য প্রাণিজ তেল অপেক্ষা উদ্ভিজ্জ তেল বেশি প্রয়োজন । প্রাণিজ তেল যেমন- ঘি, মাখন চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
স্নেহ জাতীয় পদার্থের কাজঃ
স্নেহ জাতীয় খাদ্য হতে সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয় ( ১ গ্রাম স্নেহ হতে ৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়) ।
স্নেহ জাতীয় খাদ্য তাপ কুপরিবাহী বলে দেহকে গরম রাখে।
এ খাদ্য ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে এর পরিশোষণে সাহায্য করে।
উদ্ভিজ্জ তেলের অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বক ও কোষের সুস্থতা রক্ষা করে।
খাদ্যে স্নেহ জাতীয় পদার্থ ব্যবহারের ফলে খাদ্য সুস্বাদু ও মুখরোচক হয়।
স্নেহ জাতীয় খাদ্যের উৎসঃ সয়াবিন, সরিষা, তিল, সূর্যমুখী বীজ, চীনাবাদাম, নারিকেল,পাম, তুলা বীজ, ডালডা, মার্জারীন, ঘি, মাখন, চর্বি, মছের তেল, ডিম, রাইস ব্রান তেল ইত্যাদি।
খনিজ লবণঃ দেহের অন্যতম উপাদান হচ্ছে খনিজ লবণ। যদিও দেহের প্রায় ৯৬% জৈব পদার্থ ও বাকি ৪% অজৈব পদার্থ বা খনিজ লবণ, তবুও এই অল্প পরিমাণ খনিজ লবণ দেহের কাঠামো গঠনে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। খনিজ লবণের মধ্যে সেগুলোকে Trace element বলে। তবে শরীরে প্রায় ২০টি লবণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । প্রয়োজনীয় খনিজ লবণগুলো হচ্ছে-
ক্যালসিয়াম,
পটাশিয়াম
সোডিয়াম
লৌহ
ম্যাগনেশিয়াম
ম্যাঙ্গানিজ
দস্তা
তামা
লিথিয়াম
ফসফরাস
গন্ধক
ক্লোরিন
বেরিয়াম
আয়োডিন
সিলিকন
ফ্লোরিন ইত্যাদি
এর মধ্যে ১০টি দ্বারা শরীরের ক্ষারীয় এবং ৬টি দ্বারা শরীরের অম্লভাব বজায় থাকে।
ক্ষার জাতীয় লবণঃ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, তামা, লিথিয়াম ও বেরিয়াম।
অম্ল জাতীয় লবণঃ ফসফরাস, গন্ধক, ক্লোরিন, আয়োডিন, সিলিকন ও ফ্লোরিন।
খনিজ লবণের কাজঃ
ক্যালসিয়ামঃ
এর প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের হাড় গঠন ও মজবুতকরণ। শরীরের মোট ক্যালসিয়ামের ৯৯% ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস এর সাথে যু্ক্ত হয়ে এ কাজে ব্যবহার হয়।
ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনোশিয়াম সাথে মাংসপেশি ও স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপনা ও উত্তেজনাকে প্রভাবিত করে।
রক্ত জমাটবাধা ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বদ্ধ করে।
ক্যালসিয়াম খাদ্যের উৎসঃ দুধ, দই, গুঁড়া দুধ, ডিমের কুসুম, বাদাম, শাকসবজি যেমন- সবুজ বরবটি, ব্রকলি ও পালংশাক, ঢেড়স, পনির ছোট মাছ ইত্যাদি।
লৌহঃ
রক্তের লাল অংশ ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। হিমোগ্লোবিন ফুসফুস হতে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
কিছু এনজাইম বা জারক রস গঠনে লৌহের প্রয়োজন।
লৌহ জাতীয় খাদ্যের উৎসঃ কচুশাক, লালশাক, আলু, পুদিনা পাতা, শশা, শালগম, করলা, মুলা, ডাল, পেঁয়াজ, তরমুজ, মটরশুঁটি, খেজুর, যকৃত, মাংস, ডিম,গুড়, তেঁতুল, চিংড়ি, শুটকি মাছ ইত্যাদি।
আয়োডিনঃ
আয়োডিন শরীরে থাইরক্সিন নামক হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।
থাইরক্সিন দৈনিক ও মানসিক বিকাশ বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাবিত করে।
গর্তবতী মায়ের জন্য আয়োডিন খু্বই প্রয়োজন, অন্যথায় প্রতিদন্ধী শিশু জন্ম নিতে পারে।
আয়োডিন জাতীয় খাদ্যের উৎসঃ বিভিন্ন শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ (তাজা ও শুঁটকি), শামুক, ছাগলের দুধ, শেওলা, মাছের তেল ইত্যাদি।
ভিটামিন/খাদ্যপ্রাণঃ শর্করা, আমিষ ও স্নেহ পদার্থ ছাড়াও কিছু কিছু জৈব উপাদান শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়। এগুলোকে খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন বলে। বেরিবেরি ও স্কার্ভি রোগকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন আবিষ্কার হয়েছে । বিশিষ্ট বিঙ্গানীগণ যেমন- অসবার্ন, মেন্ডেল, ম্যাককলাম ও ডেভিস প্রমাণ করেন যে লেবুতে স্কার্ভি প্রতিরোধক ভিটামিন খুবই অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়। দ্রবণীয়তার ভিত্তিতে ভিটামিন দু’প্রকার। যেমন-
চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনঃ ভিটামিন- এ, ডি, ই ও কে।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিনঃ ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন-সি।
ভিটামিনের কাজঃ
ভিটামিন-এ
চোখ সুস্থ রাখে ও স্বল্প আলোতে দেখার ক্ষমতাকে রক্ষা করে।
অস্থিকোষ ও দাঁতের গঠনকে প্রভাবিত করে।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ত্বকের কোষকে ভাল ও মসৃণ রাখে।
উৎসঃ সয়াবিন, চাল, ভুট্রা, লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, মাছের তেল, কলিজা, মাখন, ডিমের কুসুম, পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা কাঁঠাল, মিষ্টি আলু ইত্যাদি।
ভিটামিন-ডি এর কাজঃ
শরীরের অন্ত্র ও বৃক্ক হতে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণে সাহায্য করে।
শরীরের হাড় ও দাঁত সুগঠিত ও মজবুত করে।
শিশুদের রিকেট ও বয়স্কদের অস্টিওম্যালেসিয়া রোগ প্রতিরোধ করে।
উৎসঃ ডিমের কুসুম, দুধ, মাখন, ও যকৃত ও তৈলাক্ত মাছ। উদ্ভিজ্জ উৎসে সাধারণত ভিটামিন-ডি নেই।
ভিটামিন-ই এর কাজঃ
কোষের ঝিল্লি গঠন করে।
ক্যারোটিন বিপাকে সহায়তা করে।
গর্ভপাত প্রবণতা কমিয়ে দেয়।
উৎসঃ উদ্ভিজ্জ তেল (বাদাম, ভুট্রা, সূর্যমুখী, সয়াবিন, পাম, নারিকেল ইত্যাদি) এ ভিটামিনের উৎকৃষ্ট উৎস। দুধ, মাখন, ডিমেও এই ভিটামিন পাওয়া যায়।
ভিটামিন-কে এর কাজঃ
রক্ত জমাটকরণ কাজে সহায়তা করে।
রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে।
উৎসঃ লেটুস, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, মটরশুঁটি, কলিকা, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদ।
ভিটামিন-সিঃ
এটি কোলাজেন নামক আমিষ তৈরি করে হাড়, তরুণাস্থি ও ত্বকের রক্ষণাবেক্ষণ করে।
রক্তের বিশুদ্ধতা ও রক্ত গঠনে সহায়তা করে।
ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি শুকাতে সাহায্য করে।
এটি জারণ প্রতিরোধক বা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
মাংসপেশির শক্তিবৃদ্ধিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে।
দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখে।
উৎসঃ সব রকম টাটকা ফল ও সবজি, আমলকি, পেয়ারা, কুল, কামরাঙ্গা, আমড়া, আনারস, জাম্বুরা, লেবু, কাঁচামরিচ ইত্যাদি শুকনা ফল ও বিচি এবং টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে ভিটামিন-সি থাকে না।
পানিঃ আম, কাঁঠাল, ডাব,তরমুজ, পেঁপে, আনারস, জাম্বুরা, আখ বিভিন্নি প্রকার ফল ও সবজিতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে। মানবদেহের প্রায় ৬৩% পানি । শরীরে পানির ঘাটতি হলে নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়।
No comments